রাষ্ট্রভাষা, স্বাধীনতা আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
[দ্বিতীয় কিস্তি]
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যখন জন্ম হয়, তখন সেই জন্মের পেছনে একটি অতিপ্রধান ভূমিকা ছিল ভয়ের। মুসলিম মধ্যবিত্ত ভয় পেয়েছিল অবিভক্ত ভারতে তাদের ভবিষ্যৎ নেই মনে করে। সেই ভয় তারা সংক্রমিত করে দিয়েছিল জনসাধারণের মধ্যে। প্রধানত ভয়ের কারণেই ইংরেজের ভয়, তারও চেয়ে বড় ভয় হিন্দুর ভয়ের তাড়নাতেই মুসলমানদের প্রায় সব ভোটই গিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের বাক্সে। এখন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই এলো এই নতুন ভয় উর্দুর অর্থাৎ উর্দু ভাষাভাষীদের। আশঙ্কা হলো উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ফলে বাঙালিরা চিরকালের জন্য বোবা হয়ে যাবে, তারা গোলাম হয়ে যাবে পাঞ্জাবিদের। বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো সেই ভয় জাগিয়ে দিল মানুষকেÑ প্রথমে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশকে, পরে ছাত্রদের এবং তারও পরে সমগ্র দেশবাসীকে। বড় ভয় এসে ছোট ভয়কে, নিরাপত্তার ভয়কে, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারার ভয়কে জয় করে নিল। ভীত-সন্ত্রস্ত বাঙালি দেখল তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তখন মরিয়া হয়ে ওঠা ভিন্ন অন্য কোনো পথ রইল না। যে শাসকরা বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল, সেই শাসকরাই আজ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলাদেশের সব মানুষের স্বার্থ যে এক ও অভিন্ন, সেই জ্ঞানটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এনে দিল। শাসকদের স্ববিরোধিতার পুরাতন নাটক এখানেও নতুন করে অভিনীত হলো, স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই তারা স্বার্থ বিনষ্ট করল।
বলাই বাহুল্য, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না। থাকলে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হতো না। এই আন্দোলন অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে, স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত এর গতিধারা প্রসারিত। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতা এ দেশের পুরাতন ব্যাধি, ইংরেজ আমলে এই ব্যাধির প্রকোপে আমরা অনেক দুর্ভোগ সহ্য করেছি। পাশাপাশি থেকেও দুই সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতা করেছে, নিজেদের স্বার্থকে এক করে দেখতে পায়নি। ইংরেজ যুগে সৃষ্ট অতিশয় সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যে মুসলিম জীবন ও লেখকদের উপস্থিতির সামান্যতাটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, মুসলমান মধ্যবিত্ত সত্যি সত্যি পিছিয়ে পড়েছিল এবং হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে পিছিয়ে-পড়া মুসলমানের এমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, যাতে করে সাহিত্যে মুসলিম জীবন অনায়াসে চিত্রিত হতে পারে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ রদ করা সম্ভব হয়েছিল বটে, কিন্তু ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। বিভাগ মুসলমান মধ্যবিত্ত তো চেয়েছিল বটেই, শেষ পর্যন্ত হিন্দু মধ্যবিত্তের পক্ষেও না চেয়ে উপায় থাকেনি। ১৯০৫-এ যারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৭-এ তারা আর বিরোধী থাকতে পারেনি। এই রকমের একটা সাম্প্রদায়িক পরিবেশে, সাম্প্রদায়িকতার ফলে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রে এত তাড়াতাড়ি যে অসাম্প্রদায়িক গণ-আন্দোলন গড়ে উঠতে পারল, এর দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে পাকিস্তানের ব্যর্থতা ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং সেই ব্যর্থতা দেখে বাংলাদেশের মানুষ ভয় পেয়েছিল।
শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও বটে। সমাজতন্ত্রের কথা আন্দোলনের কালে স্পষ্ট করে বলা হয়নি বটে, কিন্তু সন্দেহ নেই এ আন্দোলন ছিল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার আন্দোলন। বাংলাদেশের সন্ত্রস্ত মুসলমানরা একদিন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, এর সাহায্যে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে বলে। সেই অস্ত্র যখন বরং উল্টো কাজ করবে বলে ভয় হলো, তখন তারা একে পরিত্যাগ করে অন্য একটা অস্ত্রই শানিত করে তুলতে চাইল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র। স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই অস্ত্রই মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করেছে, যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে।
বাংলা ভাষার ব্যাপারে পশ্চিমা শাসকবর্গ একগুঁয়েমির পরিচয় দিয়েছে প্রথমটায়। হয়তো তার পেছনে ভয় ছিল, স্বার্থ নষ্ট হওয়ার ভয়, কিন্তু পরে যখন তারা দেখেছে যে এ আন্দোলন কিছুতেই স্তব্ধ হওয়ার নয়, তখন ১৯৫৬ সালে এবং পরে ১৯৬২ সালের সংবিধানে বাংলাকে তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু তত দিনে বাংলাদেশের মানুষ আরও অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে। পাকিস্তানে যে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এটা তাদের জানা হয়ে গেছে এবং জানা হয়ে গেছে বলে তত দিনে তারা শুধু ভাষার অধিকার না, পূর্ব আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দাবি করেছে।
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সচেতনতা ও বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ যত বৃদ্ধি পেয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে তত বেশি চেষ্টা হয়েছে তাদের প্রলুব্ধ করার। বুদ্ধিজীবীদের পেছনে আর্থিক বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠান গড়া হয়েছে, পুরস্কার পারিতোষিকের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। বাইরে থেকে মনে হয়েছে প্রলোভনের জালে অনেকেই ধরা দিচ্ছেন। ধরা দিয়েছেন কেউ কেউ কিন্তু এমনকি যারা দিয়েছেনও তারা দেখা গেছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে পারছেন না। তার কারণ পাকিস্তানের কৃত্রিমতাটা তাদের কাছে তত দিনে ধরা পড়ে গেছে। পাকিস্তানের শাসকরা চিরকালই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে ছিল, সেই দূরত্ব যে ক্রমেই বাড়ছে, বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে সেটাও লক্ষ না করে উপায় ছিল না। সরকার টাকা দিল, কিন্তু মন গেল না। তমঘা দিল, সেই তমঘা পরে কেউ কেউ পরিত্যাগ করলেন, করে বিব্রত করলেন সরকারকে। সরকার সাহিত্যের জন্য পুরস্কার দিল, কিন্তু সেই পুরস্কার সরকারবিরোধীরা পাওয়া শুরু করলেন। এমনকি পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার ওপর প্রচ্ছন্ন বিদ্রƒপকারী রচনাও পুরস্কার নিয়ে গেল। সরকার টাকা দিল লেখক সংঘ গড়ার জন্য, কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেল লেখক সংঘ সরকারি নীতির সমর্থন তো করছেই না, পরন্তু প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে।
সরকার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও পশ্চিম পাকিস্তানের ইতিহাস যে অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত তা প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু ইতিহাস তো সরকারের কেনা গোলাম নয়, ইতিহাস ওই কৃত্রিম ছকে আবদ্ধ হতে রাজি হয়নি। অতীতের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা সফল হয়নি, বাংলাদেশের মানুষ তাতে আস্থা রাখেনি এবং চলমান ইতিহাসের ধারা তো চোখের সামনেই দেখা গেছে দুই ভিন্ন দিকে চলেছে। চেষ্টা হয়েছে এটা প্রমাণ করার যে বাংলা ও উর্দু ভাষার মধ্যে সাধারণ ঐতিহ্য আছে, আছে নিকটবর্তিতা। কিন্তু এসব কথাতেও বাংলাদেশের মানুষ সাড়া দেয়নি। উর্দু যে বাংলার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এ কথা তারা কিছুতেই ভুলতে পারেনি। বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও সরকারি কাজের ভাষা হিসেবে প্রয়োগ করার দাবি বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তুলেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও দাবি উঠেছে উর্দুর পক্ষে। মাতৃভাষাকে জীবনের সর্বত্র প্রচলিত করার পক্ষে দুই পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা অনেক সময় একসঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন এই দাবি গভীর দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত। তা উৎসারিত ঠিকই, কিন্তু সে দেশ এক দেশ নয়, দুই দেশ। উর্দু প্রচলনের দাবি বাংলার আন্দোলনকে সাহায্য করেছে। সরকার চেষ্টা করেছে ধর্মের কথা বলতে, পাকিস্তান না থাকলে ইসলাম থাকবে না, ইসলাম না থাকলে বেঁচে থেকে কী লাভÑ এ ধরনের যুক্তির অবতারণা করতে, কিন্তু এই ধর্মীয় প্রতারণাতেও কোনো সুফল হয়নি।
(শেষ অংশ পড়ুন বুধবার ৩য় কিস্তিতে)
লেখক
ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়