পণ্যমূল্যে করোনার আঘাত
প্রান্তডেস্ক:বাংলাদেশে এখনো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি কেউই। কেবল সতর্কতার কারণে কেউ কেউ সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার শুরু করেছেন। আর তাতেই সোয়া টাকার পণ্যটি এখন ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদা বাড়েনি এমন অনেক চীনা পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করেছে হু-হু করে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আমদানি বন্ধ হওয়ার আগে থেকেই চীনা পণ্য মজুদ করায় তৈরি হচ্ছে
কৃত্রিম সংকট,পাইকারি থেকে ফুটপাত পর্যন্ত বেড়েছে দাম। আদা-রসুনের মতো ভোগ্যপণ্য, চিকিৎসাসামগ্রী, ইলেকট্রনিক পণ্য, জুয়েলারি থেকে শুরু করে চীন থেকে আমদানি হওয়া গৃহস্থালিতে, পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিত্য ব্যবহৃত সব পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। শুধু চীনা পণ্যই নয়, দাম বেড়েছে অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যেরও।
গত দু’দিন রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি, খুচরা মার্কেট ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, আগে খোলা এলসির (ঋণপত্র) পণ্য এখনো আসছে চীন থেকে। তাই আমদানি-পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চীনা পণ্যের এখনো কোনো সংকট নেই। তবে ২৪ জানুয়ারি থেকে চীন যেহেতু পণ্য জাহাজীকরণ বন্ধ রেখেছে, তাই খুব শিগগিরই চীনা পণ্য আসা বন্ধ হয়ে যাবে। চীন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আসতে ২২ থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তাই বন্ধের আগে জাহাজীকরণ পণ্য ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আসবে। তারপর থেকে চীনা পণ্য আসা বন্ধ হবে এবং চীন জাহাজীকরণ শুরু করার ২২ থেকে ২৮ দিন পর থেকে স্বাভাবিকভাবে আসতে শুরু করবে। মাঝখানের এই সময়ে চীনা পণ্যের সংকট হতে পারে আশঙ্কা করে বড় আমদানিকারকরা এখনই মজুদ করতে শুরু করেছেন। ফলে পাইকারি মার্কেটে চীনা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে খুচরা মার্কেট থেকে ফুটপাতের হকারের দোকান পর্যন্ত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ তার মোট আমদানি পণ্যের ৩০ ভাগই আনে চীন
থেকে। ভোগ্যপণ্যের বাইরে এমন কোনো পণ্য নেই, যা চীন থেকে আমদানি হয় না। আসবাবপত্রের স্ক্রু থেকে শুরু করে উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, রিকশায় ব্যবহৃত পিন থেকে শুরু করে প্রিন্টারের কালি, সুঁই থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য সবই আসে চীন থেকে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘ চীন থেকে বাংলাদেশ ১২০০ থেকে ১৫০০ পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে রান্নাঘরে ব্যবহৃত আদা-রসুনের পরিমাণ খুবই কম। শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য বাল্ক আকারে আসে। ঘর, অফিস-আদালতসহ সর্বস্তরেই দৈনন্দিন ব্যবহৃত হচ্ছে চীনা পণ্য। করোনাভাইরাসের প্রভাব সবক্ষেত্রেই কম-বেশি পড়ছে।’
চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবরে দেশে প্রথম বাড়তে থাকে আদা-রসুনের দাম। এ দুটি পণ্যের কেজি ২০০ টাকার গ-ি পার করছে। মাসখানেক আগে দুটি পণ্যের দরই ১৫০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে ছিল।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ইলেকট্রনিক পণ্যের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স আদম ইলেকট্রনিক্সের বিক্রেতা সুহৃদ পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি? সব ধরনের চীনা ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দামই বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ওয়াই-ফাই সংযোগে ব্যবহৃত রাউটার আমরা কিনতাম ৬৫০ টাকা, বিক্রি করতাম ৯০০ টাকায়। এখন আমাদেরই কিনতে হচ্ছে ৮০০ টাকা। ক্রেতাদের কাছে ৯৫০ টাকা বিক্রি করতে চাইলেও বাক-বিতন্ডা হয়। তারা কিনতেও চান না।
তিনি বলেন, দোকানে যা আছে, সবই চীনা পণ্য। আর সবকিছুর দামই বাড়তি। বড় আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটর দেখিয়ে তিনি বলেন, আগে এটি ২৫০ টাকায় বিক্রি করতাম, এখন ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। হ্যান্ডমাইকের দাম এতদিন ছিল ১৯০০ টাকা, এখন ২৩০০ টাকা।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেটের শরীফ এন্টারপ্রাইজের মালিক শেখ আরিফুল হক মিঠু বলেন, প্রায় সব চীনা পণ্যেরই দাম বাড়ছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টারে ব্যবহৃত কাগজ, পিপি, ইউডিএফ, সিপিওর দাম আগে ৭০-৭৫ টাকা ছিল, এখন ৮০-৮৫ টাকা। ইঞ্চিভেদে এলইডি টিভির দাম বেড়েছে দু’ হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, ট্রিটন, জেভিকো, সনি প্লাসসহ নানা ব্র্র্যান্ডের ৩২ ইঞ্চি এলইডি টিভি গত সপ্তাহে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন বেড়ে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার হয়ে গেছে। সিগো ব্র্যান্ডের দেড় টনের প্রতিটি এয়ারকন্ডিশনার ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার বেড়ে ২৯ হাজার ৫০০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গ্রি, মিডিয়া এয়ার কন্ডিশনারে দামও দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বিভিন্ন চীনা ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটরের দাম।
রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে মোবাইল হ্যান্ডসেট ও মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রেতা জিএসএম প্লাসের বিক্রেতা সাগর আহমেদ বলেন, চীন থেকে আসা সব ধরনের মোবাইল হ্যান্ডসেট, এক্সেসরিজের দাম বেড়ে গেছে। সপ্তাহখানেক আগেও রেডমি নোট-৮ মডেলের হ্যান্ডসেট বিক্রি করতাম ১৪ হাজার ৫০০ টাকা, এখন আমাদেরই কিনতে হচ্ছে ১৬ হাজার টাকায়। অথচ এই সেটের দাম আরও কমার কথা। যেসব এক্সেসরিজ আগে ২ হাজার টাকায় কিনতাম, এখন কিনতে হচ্ছে আড়াই হাজার বা তার চেয়ে বেশি দরে।
তিনি বলেন, সব ধরনের মোবাইল সেটের ব্যাটারি, ব্যাক-কাভার, বিভিন্ন পার্টস, হেডফোন, মেমোরিকার্ডের দামও বেড়ে গেছে। দোকানগুলোতে এসব পণ্যের মজুদ নেই, সরবরাহও নেই। কোনো দোকানেই নতুন ব্যাটারি নেই। মেমোরি চিপসের দাম ৫০ টাকা থেকে দেড়শ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
রাজধানীর তোপখানা রোডের ইলেকট্রো মেডিকেল ইক্যুইপমেন্টের আমদানিকারক ও ডিস্ট্রিবিউটর পদ্মা মেডিকেল সার্ভিসের মালিক মো. তৌহিদুল ইসলাম তালুকদার (মানিক) বলেন, করোনাভাইরাসের আগে প্রতি কার্টন সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হতো ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা। তাতে প্রতি পিচের দাম পড়ত ১ থেকে সোয়া টাকা। এখন সেই কার্টনের দাম ৫৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। ১ টাকার মাস্ক এখন ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, চীন থেকে মাস্ক আসছে না। দেশের কিছু কোম্পানি মাস্ক উৎপাদন করে সরাসরি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করে। ফলে বাজারে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না।
মানিক জানান, কেবল মাস্কই নয়, স্যালাইন সেট, ইউরিন ব্যাগসহ সব ধরনের ডিসপোজাল আইটেমের দাম বেড়ে গেছে। জিএমআই এ ধরনের পণ্য উৎপাদন করলেও বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, তাই দাম বাড়ছে।
রাজধানীর পল্টনের আশফিয়া স্টেশনারির বিক্রয়কর্মী মিজানুর রহমান বলেন, চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাবে সব ধরনের স্টেশনারির দাম বেড়ে গেছে। আইডি কার্ডের কাভার, ফিতা, এ৪ কাগজ, কার্ট্রিজ, টোনারসহ চীনা সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, আইডি কার্ডের কাভার আগে ছিল ৪ টাকা, এখন ৬ টাকা, ফিতার দাম ৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০ টাকা হয়েছে। এ৪ সাইজ কাগজের প্যাকেট ৩৮০ টাকা ছিল, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। টোনারের দাম ১৫ দিন আগে ৩৫০ টাকা ছিল, এখন তা ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পল্টনে মোস্তফা প্যাকেজিংয়ের মালিক গোলাম মোস্তফা জানান, কেবল চীনা পণ্যের দামই বাড়েনি। চীন থেকে পণ্য আসা বন্ধ হওয়ায় অন্য দেশ থেকে আসা একই ধরনের পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। যেমনÑ প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহৃত কোরিয়ান ডুপ্লেক্স বোর্ডের দাম সপ্তাহখানে আগে ছিল ১৭শ, এখন ২১শ টাকা।
চকবাজার সার্কুলার রোডের জুয়েলারি ও কসমেটিক্স পণ্যের পাইকারি প্রতিষ্ঠান চায়না ট্রেডার্সের বিক্রেতা মো. মাহিন বলেন, ‘আমরা চীন থেকে আমদানি করি। দেড় মাস আগে খোলা এলসির পণ্য এখনো আসেনি। তাই দোকানে মালের সংকট। এ কারণে দামও বেড়ে গেছে। এ অবস্থা শুধু আমাদের নয়, অন্যদেরও। ’
বিভিন্ন ধরনের জুয়েলারি পণ্যের দাম কেমন বেড়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে যে পণ্য ৫০০ টাকায় বিক্রি করতাম, এখন তা ৫৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। মাসখানেকের মধ্যে চীন থেকে পণ্য না এলে দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। এ অবস্থা শুধু আমাদের নয়, চকবাজারের অন্য দোকানগুলোরও।
সারা দেশে শিশুদের বিভিন্ন খেলনার বড় অংশই আসে চীন থেকে। চকবাজারের ব্যবসায়ীরা সেগুলো আমদানির পর পাইকারি বিক্রির পর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন মার্কেট ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে। চকবাজারের ভাই ভাই স্টোর তেমনি এক পাইকারি দোকান। বিক্রেতা মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘২ টাকার মাল হয়ে গেছে ৫-৬ টাকা। বড় আমদানিকারকরা মাল মজুদ করছে, ঠিকমতো সাপ্লাই নাই। দাম বাড়ায় খুচরা দোকানদার ও হকাররাও এখন আসছে না।’
রাজধানীর প্রগতি সরণির শাহজাদপুরের সুবাস্তু নজরভ্যালি মার্কেট সংলগ্ন ফুটপাতে খেলনা বিক্রি করেন রমজান আলী। তিনটি ঘড়ির ব্যাটারিতে দুই চোখের পাশে আলো জ্বলে এমন একটি স্পাইডারম্যানের মাস্কের দাম জানতে চাইলে তিনি ২৮০ টাকা চান। এত দাম কেন, জানতে চাইলে বলেন, এগুলো ১০০-১৫০ টাকা করে বিক্রি করতাম। এখন চীন থেকে আসছে না। তাই দাম বেশি। এক দাম ২০০ টাকা হলে নিতে পারবেন।