সীমান্ত হত্যা আর এনআরসি: ভারতের রাজনীতি যখন বাংলাদেশের মাথাব্যথা
প্রতি বছর সীমান্তে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মতে, ২০১৯ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) হত্যা করেছে কমপক্ষে ৪৩ জন বাংলাদেশিকে।
শুধু তাই নয়, ৪৩জন বাংলাদেশির মধ্যে ৩৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং বাকিরা নিহত হয়েছেন নির্যাতনের শিকার হয়ে।
আমাদের মনে আছে কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানির রক্তাক্ত শরীরের কথা। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে গরু চুরির অভিযোগে নির্মমভাবে সাধারণ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা হলেও এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিবাদ, নিন্দা জানানো ছাড়া বিশেষ কোনো প্রতিবাদ-সমাবেশ, প্রতিক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় নি।
উল্টো কখনও কখনও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের কিছু কিছু মন্তব্য আমাদের অবাক করছে।
যেমন, সাম্প্রতিক সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার প্রেক্ষিতে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ইণ্ডিয়ায় গিয়ে গুলি খেয়ে মরলে, তার জন্য বিএসএফের দোষ নাই, দোষ বাংলাদেশি নাগরিকদেরই।”
কেউ অবৈধ ভাবে সীমান্ত পাড়ি দিলে আইন অনুযায়ী তাদের গ্রেফতার করা ও বিচার করার বিধান থাকলেও, দীর্ঘদিন ধরে নির্মম ভাবে মানুষকে গুলি করে, নির্যাতন করে মেরে ফেলা হচ্ছে। অদ্ভুতভাবে আমাদের মন্ত্রী এই অমানবিক, অবৈধভাবে হত্যার পক্ষে কথা বলছেন , যা সীমান্ত আইনের পরিপন্থী বক্তব্য।
তবে, এবার ‘বাংলাদেশের জনগণ’ ব্যানারে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অংশ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাদের মিছিল করতে দেখি আমরা।
রামপাল নিয়ে উদ্বেগ
এর কিছুদিন আগে গত অক্টোবরে, সুন্দরবনের পাশে রামপালসহ সকল শিল্প নির্মাণ প্রক্রিয়া বন্ধ ও সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন করার দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ”স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর শোষণ করে এদেশের সকল সুযোগ সুবিধা চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে।
”একইভাবে এখন ভারতের যতো ক্ষতিকর প্রকল্প আছে তা বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে করছে ভারত। কিন্তু সমস্ত সুযোগ-সুবিধা চলে যাবে ভারতে,” তিনি বলেন।
সুলতানা কামালের এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের ভেতরে একরকম ভারত বিরোধিতা থাকলেও বর্তমান সরকার বরাবরই বলে আসছে এই সময়টা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের স্বর্ণ-যুগ। কিন্তু এই স্বর্ণ-যুগে আমরা ভারতের কাছ থেকে কী পেয়েছি ? ভারত কি আসলেই স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানকে যেভাবে শোষণ করা হতো সেভাবে আমাদের শোষণ করছে, ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন মাত্রায় ?
এই সরকারের তিন মেয়াদে নানা চুক্তি নিয়ে বিস্তর সমালোচনা, প্রতিবাদ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলী যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ।
বাংলাদেশের জন্য একটি অনেক বড় সঙ্কট রোহিঙ্গা শরণার্থী। একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল মানবাধিকার সম্পৃক্ত বিষয়ে ভারত মানবাধিকার বিরোধী অবস্থানই শুধু নেয়নি, কূটনৈতিক তৎপরতায় চীন-রাশিয়ার সাথে থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছে।
গত ১০ই জানুয়ারি থেকে ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী বা সিএএ অফিসিয়ালি কার্যকর হয়েছে বলে গেজেট হয়েছে। মোদী সরকার এই সিএএ বাস্তবায়ন করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে।
ইতোমধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এ নিয়ে এক প্রস্তাব পেন্ডিং হয়ে আছে যেখানে তারা এটাকে সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রহীনতায় পড়া মানুষের সংকট হিসেবে দেখছে”, “set to create the largest statelessness crisis in the world and cause immense human suffering”।
আসামে বসবাসরত মুসলমানরা, তারা বা তাদের বংশধররা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ছিল না, তা প্রমাণে ব্যর্থ হলে নাগরিকত্ব পাবে না কারণ, নতুন আইন শুধুমাত্র তিনটি দেশ থেকে আসা অ-মুসলিম অভিবাসীদের ক্ষেত্রে নাগরিক হবার সুবিধা দেবে।
এই প্রসঙ্গে ওসমান সেম্বেনের নির্মিত মান্দাবি অর্থাৎ ‘ মানি অর্ডার’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র এব্রাহিম দিয়েঙ্গের কথা উল্লেখ করা যায়।
সহজ সরল এব্রাহিমের কাছে আলাদিনের চেরাগের মতো আসে এক মানি অর্ডার। কিন্তু পড়ালেখা না জানা, নিয়মকানুন না জানা এব্রাহিম কি করে মানি অর্ডার ভাঙবে তা জানে না। এব্রাহিমের জন্ম হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। তখন জন্মের রেকর্ড তেমন রাখা হতো না। ফলে পাসপোর্ট করতে গিয়ে সে নানা সমস্যায় পড়ে। সে জন্ম নিবন্ধন খুঁজে পায় না। শেষপর্যন্ত সঠিক জন্ম তারিখ না জানায় অসহায় এব্রাহিম একটা পরিচয় পত্র পায় না, আর পরিচয় পত্র না থাকায় আলাদিনের চেরাগের ধন মানি অর্ডারটিও ভাঙতে পারে না এব্রাহিম।
উনিশ লক্ষ ‘রাষ্ট্রহীন’
আসামের এনআরসি প্রক্রিয়ায় আসাম রাজ্যে প্রায় ১৯ লক্ষ অভিবাসী নিজের নাগরিকত্ব ডকুমেন্ট যোগাড় করে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, যাদের মধ্যে পাঁচ লক্ষ মুসলমান। আসামের বিজেপির মতে যাদের পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশের।
যে সকল মুসলমানরা ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের পরে ভারত গেছেন বা যারা ওসমান সেম্বেনের ছবির মত নতুন এক বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে পড়া সরল এব্রাহিমের মতো নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে পর্যাপ্ত দলিল প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন, আসামে এমন অনেকের অবস্থা ঝুলন্ত।
স্ট্যাটাস কো হিসাবে অনেকে বাসাতেই এখনও আছে, কিন্তু অনেকে ইতোমধ্যেই ডিটেনশন সেন্টারে। এনআরসি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বিরোধী কংগ্রেসকে উদ্দেশ্য করে সদর্পে বলেছেন, ”এটি বাস্তবায়নের সাহস আপনাদের নেই, আমাদের আছে।” তিনি আরও বলেন, ”বাংলাদেশি অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়ার সাহস আপনাদের নেই।”
বিজেপির দলীয় প্রধানের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি তুলে তেলেঙ্গানার এমএলএ রাজা সিং বলেন, ”রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীরা সসম্মানে দেশ না ছাড়লে তাঁদের গুলি করে নির্মূল করা হবে।” ভয়াবহ কথা !
মোদীর মৌখিক প্রতিশ্রুতি
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব তাড়াতাড়ি সেরকম কিছু না ঘটলেও, প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। এই আশংকার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের হাতে আছে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া মোদীর মৌখিক প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের প্রতিশ্রুতির ইতিহাস সুখকর নয়। আমরা পাবলিকলি ভারত সরকারকে বাংলাদেশে মুসলমানদের ফেরত পাঠানো প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে শুনলেও এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে এই ধরণের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে কোনো বিবৃতি রাখতে দেখিনি।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দুবাই থেকে প্রকাশিত ইংরাজি দৈনিক গালফ নিউজ পত্রিকায় সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাতকারে সরাসরি ভারতের নাগরিকত্ব আইন (সংশোধিত) বা সিএএ-কে সমালোচনা করে “অপ্রয়োজনীয়” বলেছেন, “We don’t understand why [the Indian government] did it. It was not necessary,”।
বলাবাহুল্য যে এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদী সরকারের সমালোচনা করে কোনো মন্তব্য করলেন। প্রধানমন্ত্রী ভারতের কাছে কোনো প্রতিদান চান না জানিয়ে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ”আমার নেয়ার অভ্যাস কম, দেয়ার অভ্যাস। ভারতকে যা দিয়েছি আজীবন মনে রাখবে।”
কিন্তু একটি দেশকে একাধারে একটি সরকার সুবিধা দিয়ে যাবে, এবং বিনিময়ে প্রতিদান চাইবে না এটা কোনো পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে পড়ে কি ?
হিসেব কষার সময়
ভারত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সুবিধাকে আজীবন মনে রাখুক বা না রাখুক এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ সরকারের হিসেব কষার।
নইলে হয়তো মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের মতো বাংলাদশের আপামর জনসাধারণ অচিরেই বলবে, একসময় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান যেভাবে শোষণ করতো, ভারত বাংলাদেশকে এখন একই ভাবে শোষণ করছে।
সেক্ষেত্রে আগামীতে ভারতের কাছে নমনীয় হয়ে থাকার দায়-ভার বহন করা বর্তমান সরকারি দলের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য তা হবে ভয়াবহ ক্ষতিকর।