‘অনিয়মে’ ব্যয় বেড়েছে নাহিয়ান ট্রাস্টের
এতিম শিশুদের কল্যাণে যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল-নাহিয়ান ট্রাস্টের (বাংলাদেশ)’। নিয়ম থাকলেও ১০ বছর ধরে হয় না অডিট। আর্থিক সঙ্কটসহ নানা কারণে আয় বাড়েনি, বরং বেড়েছে ব্যয়।
আল নাহিয়ান ট্রাস্ট নামে পরিচিত এই ট্রাস্টের সার্বিক বিষয় তদন্ত করে সম্প্রতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে একটি সংসদীয় উপ-কমিটি।গত বছরের জুলাই মাসে ট্রাস্টের সার্বিক বিষয় তদন্ত করার জন্য তিন সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
কমিটির সদস্য বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেনকে উপ-কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। উপ-কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- আ কা ম সরওয়ার জাহান ও আরমা দত্ত।
১৯৮৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সময় এতিম শিশুদের কল্যাণে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলে ওই বছরের ২২ জুন গঠন করা হয় আল নাহিয়ান ট্রাস্ট, যার দেখভালের দায়িত্বে আছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
শুরুতে আরব আমিরাত ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দিয়েছিল। পরে সরাসরি ঠিকাদার নিয়োগ করে বাংলাদেশে ট্রাস্টের অধীনে একমাত্র আয়ের উৎস বনানীর আবাসিক ফ্ল্যাট ও শপিং কমপ্লেক্সের দোকানগুলো নির্মাণ করে দেয়।
দুই দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি দেবে বাংলাদেশ সরকার, অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনা খরচ দেবে আরব আমিরাত সরকার। অথচ এ পর্যন্ত কত অর্থ সহায়তা পাওয়া গেছে, তার কোনো তথ্য এ প্রতিষ্ঠানে নেই।
সংসদীয় উপকমিটির তদন্তে দেখা গেছে, মিরপুর ও লালমনিরহাটে এতিমখানা দুটি পরিচালিত হচ্ছে না সঠিকভাবে। টানা আর্থিক সংকটে লালমনিরহাটের ২০০ আসনের এতিমখানায় এখন রয়েছে মাত্র ১৩০ জন এতিম। মিরপুরে ২০০জনের জায়গায় আছে ১০৮ জন শিশু।
মিরপুরের শিশু পরিবারটি ১৯৮৭ সালে আর লালমনিরহাটেরটি ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালে মিরপুরে হাইস্কুল করার পর থেকে ব্যয় বাড়তে থাকে। যে কারণে ২০০৬ সাল থেকে লোকসানে পড়ে ট্রাস্টের কাজ।২০১৮ সাল পর্যন্ত ২ কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে স্কুলটিতে।
লালমনিরহাট শিশু পরিবার পাঁচ একর জায়গায়, আর মিরপুরের শিশু পরিবার দুই দশমিক ৭০ একর এলাকায় অবস্থিত। ট্রাস্টের অধীনে রাজধানীর বনানীতে ১৮টি ফ্ল্যাট এবং ইউএই মৈত্রী শপিং কমপ্লেক্স রয়েছে। ১৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২জন ভাড়াটিয়া উচ্চ আদালতে মামলা করে নির্ধারিত ভাড়া না দিয়ে ৩০ হাজার টাকা করে দিচ্ছে।
এই শপিং কমপ্লেক্সের ৬০টি দোকান আর ১৮টি ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে বর্তমানে ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে।
তদন্ত করতে গিয়ে কমিটি দেখেছে, ২০০৯ সালের পর দীর্ঘদিন ট্রাস্টের কোনো অডিট করা হয়নি। ট্রাস্টের কাছে বেশ কয়েক দফায় তাগিদ দিয়েও তহবিল ও সম্পদের পরিমাণ, আয়-ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো জবাব পায়নি সংসদীয় কমিটি।
২০০৫-০৬ অর্থবছরের পরে ট্রাস্টের আর কোনো নিরীক্ষা প্রতিবেদন নেই। পরবর্তী বছরগুলোতে নিরীক্ষা প্রতিবেদন চলমান বলে কমিটিকে দেখানো হয়েছে। প্রায় ১০ বছর কেন অডিট করা হয়নি সে বিষয়ে কোন সদুত্তর পায়নি কমিটি।
উপ-কমিটি সুপারিশে বলেছে, ট্রাস্টের অডিট কার্যক্রম অতি দুর্বল। অডিটে ম্যানেজমেন্ট রিপোর্ট নেই। কনসুলেটেডে অডিট রিপোর্ট নেই।
কমিটি টার্ম অব রেফারেন্স তৈরী করে প্রথম শ্রেণীর অডিট ফার্মকে নিয়োগ দিতে বলেছে। একইসঙ্গে ১০ বছর অডিট না হওয়ায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
উপ-কমিটির আহ্বায়ক বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ বলেন, “সার্বিকভাবে ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ঘাটতি ছিল। সেই কারণেই অনিয়মগুলো হয়েছে। কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলোর প্রতিপালন হলে সার্বিকভাবে অবস্থান উন্নতি ঘটবে।”
২০১২ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন কেবিএম ওমর ফারুক চৌধুরী। অবসরে যাওয়ার পরেও মৌখিকভাবে আদেশে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
উপ-কমিটি এ পদে তিন বছরের জন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, উপ-কমিটির বৈঠকে ট্রাস্টে আমিরাত সরকারের কাছ থেকে কী পরিমাণ আর্থিক সহায়তা পাওয়া গেছে, তাও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। পরিচালক নিজেও সে তথ্য দিতে পারেনননি।
ট্রাস্টের কার্যক্রম মূল্যায়নে করতে গিয়ে উপ-কমিটি দেখেছে, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সাল নাগাদ ঘাটতি ছিল ২ কোটি ২৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা। ১৯৮৭ সালে যাত্রা শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিল। এরপর প্রতি বছরই লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। মিরপুরে স্কুল করার পর থেকে এই লোকসান শুরু হয়।
২০০৯ সালে সরকার ঘোষিত বেতন স্কেল চালু করতে পারেনি ট্রাস্ট। ২০১০ সালে ট্রাস্টের সভায় ওই বেতন স্কেল চালু না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুই বছর পরে ওই বেতন স্কেল চালু করা হয়। ২০১৫ সালে বেতন স্কেল ঘোষণা হলে ঘাটতি আরও বাড়ে। স্কুলেই প্রায় ৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
উপ-কমিটি তদন্তের সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের মতামত নেওয়া হয়। সংসদীয় কমিটিকে তিনি জানান, পরিপূর্ণ সুযোগ থাকার পরেও এতিমখানার ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ট্রাস্টটি লোকসানে থাকার জন্য পরিচালনার দুর্বলতার কথাও তুলে ধরেন রাষ্ট্রদূত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেও বনানী শপিং কমপ্লেক্সে দুটি টাওয়ার নির্মাণের কথা ছিলো। দীর্ঘদিন এ কাজে কোন অগ্রগতি ছিল না। সম্প্রতি দুটি টাওয়ার নির্মাণের জন্য বিআরবি কেবলসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
কমিটি বলছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশানুসারে টাওয়ার দুটি নির্মাণ হলে ট্রাস্ট লাভজনক হতো। আর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে বাস্তব অগ্রগতি অনেক কম।
দুটি ফ্ল্যাট নিয়ে আদালতে যে রিট আবেদন আছে, সে বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে সংসদীয় কমিটি। এছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজের বৈঠক প্রতি তিন মাস পর পর করার সুপারিশ করা হয়।
আল নাহিয়ান ট্রাস্টের নিয়োগেও অনিময় পেয়েছে উপ-কমিটি। ২০১৮ সালে ২ জনের নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে বলে মনে করছে কমিটি। এছাড়া ৩৫টি শুন্য পদে বিধি অনুযায়ী নিয়োগে দিতে বলেছে কমিটি।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উপ-কমিটির সুপারিশগুলো মন্ত্রণালয়কে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। অনেক বিষয়ে এখানে চরম অনিয়ম হয়েছে। বর্তমান মন্ত্রী চেষ্টা করছেন ট্রাস্টকে একটা নিয়মে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে “যাচ্ছেতাইভাবে অনিয়ম হয়েছে। নির্বাহী পরিচালককে অবিলম্বে সরিয়ে সেখানে নতুন নিয়োগ দিতে বলা হয়েছে।”