সমাজ পরিবর্তনে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকর্মী
সংস্কৃতি যে কত জরুরি, তা আমরা সবাই বুঝি। সোভিয়েত ইউনিয়নে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যেটা ছিল শ্রেণিহীন। একটা সমাজও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যেটা শ্রেণিহীন, কিন্তু যেখানে তার দুর্বলতা ছিল তা হলো সংস্কৃতি। সমাজতান্ত্রিক মানুষ পুঁজিবাদী মানুষ থেকে আলাদা ধরনের। এই ভিন্ন ধরনের মানুষ তৈরি করার অঙ্গীকারই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং লেনিন সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো, সমাজও প্রতিষ্ঠিত হলো, কিন্তু নতুন মানুষ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হলো না। গড়ার কাজটা চলছিল, কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পুঁজিবাদের সঙ্গে তার যে দ্বন্দ্ব, সেখানে সে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। চীনে মাও সেতুংও বুঝেছিলেন, তার রাষ্ট্র পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু সংস্কৃতিতে পুরনো মূল্যবোধগুলো রয়ে গেছে, পুঁজিবাদী আগ্রাসন রয়ে গেছে, সামন্তবাদী পিছুটান আছে, আমলাতান্ত্রিকতা আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আমলাতন্ত্র; মাও সেতুংও দেখছিলেন তার দেশেও সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই আমলাতন্ত্রই, যে আমলাতন্ত্র সমাজতন্ত্রবিরোধী। আমাদের দেশে আমরা, আমলাতন্ত্রের খোঁজ রাখি। রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু আমলাতন্ত্র অনেক বেশি নির্মম, অনেক বেশি কঠিন, অনেক বেশি দুঃসহ হয় যদি তা দলের নামে চলে। সোভিয়েত ইউনিয়নে দলের অর্থাৎ পার্টির আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। মাও সেতুং দেখছিলেন, তার রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তিনি তাই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, যা খুবই প্রয়োজন ছিল। যেমন করে বাড়িতে ময়লা জমলে তা পরিষ্কার করতে হয়, তিনিও চেষ্টা করছিলেন তেমনিভাবে রাষ্ট্রীয় ময়লা সাফ করতে, কিন্তু সক্ষম হননি।
আমরা আজ বুঝতে পারছি, নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলা কত প্রয়োজন। সেই সংস্কৃতি পুঁজিবাদী সংস্কৃতি থেকে আলাদা হবে। পুঁজিবাদের মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু হলো ব্যক্তিগত মুনাফা। পুঁজিবাদে নিজের কতটা উন্নতি হলো, সম্পদ বাড়ল এটা দেখে জনগণের উন্নতির পরিমাণ ঠিক করা হয়। আর সমাজতন্ত্রের কথা হলো সমাজের উন্নতি। সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার হচ্ছে এগিয়ে যাওয়া; সামন্তবাদে চলে যাওয়া নয় বা প্রাচীন জীবনধারায় প্রত্যাবর্তন নয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের আধুনিক অর্জনগুলো থাকবে কিন্তু ওই অর্জনগুলোর বিতরণ ও উপভোগ সব মানুষের জন্য সম্ভব হবে এবং সমাজ মুনাফার খাতিরে চলবে না, মানুষের মঙ্গলের জন্য চলবে। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে। এই যে দুই মতবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র, এরা যে পরস্পরবিরোধী মতবাদ এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। এ কথাটা আমরা আমাদের সমাজেও বুঝি। আমাদের রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক। যে অর্থনীতি আমরা পেয়েছি সেটা একটা পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং যে আদর্শ এখানে প্রতিষ্ঠিত তা পুঁজিবাদী আদর্শ। যখন নির্বাচনের কথা আসে আমরা তখন পুঁজিবাদী সমাজের চেহারা আবার নতুন করে দেখি। অধুনালুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিরপেক্ষ, নির্দলীয় বলা হয়েছিল। ওই সরকার নির্দলীয় হতে পারে, কিন্তু নিরপেক্ষ নয়। কেননা এই সরকার যত দল নির্বাচনে দাঁড়ায়, তাদের সবার সমর্থক নয় ঠিকই, কিন্তু অবশ্যই বড় দুই দলের সমর্থক এবং তাদের একটি অথবা অপরটি যাতে নির্বাচিত হতে পারে তার ব্যবস্থা করতেই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিযুক্ত ছিল। তাই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার মোটেই নিরপেক্ষ ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বস্তি উচ্ছেদ করেছে, রিকশাওয়ালাদের হটিয়ে দিয়েছে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ওপর লাঠি চালিয়েছে। এ তো গরিবের বন্ধু ছিল না, ধনীর বন্ধু বটে। এ সরকারই আবার নির্বাচন আইন সংস্কার করে, কিন্তু ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না এমন আইন করেনি। তাই ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। যারা জনগণের কোটি কোটি টাকা লুট করেছে। আরও টাকা লুট করার জন্য তারা নির্বাচিত হবে। বিলুপ্ত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মূল কথা ছিল এই যে, বড় দুই দলের এক দল জিতবে, তারাই দেশ শাসন করবে। আমরা নিরপেক্ষতা কোথাও দেখিনি। রাজনীতিতে নিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই।
আসলে প্রকৃতির জগতে এবং সংস্কৃতির জগতেও নিরপেক্ষ অবস্থান বলতে কোনো অবস্থান নেই। হয় পক্ষে অবস্থান, না হয় বিপক্ষে এবং সংস্কৃতির কথা যখন আসে তখন আমরা বৈচিত্র্য নিশ্চয়ই চাইব, সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বহুমুখিতা চাইব, বহুমাত্রা চাইব, তার বিকাশ নানা পথে হবে, তার উৎকর্ষ নানা দিকে বিকশিত হবে, এটা চাইব। কিন্তু আমরা একই সঙ্গে ঐক্যও চাইব। সে ঐক্য দেশের মধ্যে এবং সে ঐক্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গেও। তবে এই আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে বিশ্বায়নের যে তফাত, সে তফাতও আমরা ভুলে যাব না। বিশ্বায়ন বলতে এখন যা বোঝায় তা হলো বাজার অর্থনীতি। বিদেশি চালান চলে আসবে, আমরা সে পণ্য কিনব, সেই পণ্য বেচাকেনা করব, সেই পণ্য আমরা ভোগ করব। আমাদের নিজস্ব শিল্প বিকশিত হবে না এবং এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দেখছি কেমন করে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা লালন আখড়ার কথা উদাহরণস্বরূপ বারবার বলি। লালনের আখড়া কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে আছে। সেটাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কারা ধ্বংস করছে? সরকারি লোকরা সেটাকে ধ্বংস করেছে এটা আমরা দেখলাম। কিন্তু এর পেছনে যে উদ্দেশ্য আছে, তা হলো বাজার অর্থনীতি চালু হবে। আখড়ার কোনো নিজস্বতা থাকবে না, আমাদের সংস্কৃতির দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না। বাজার হবে, কোকাকোলা বিক্রি হবে, পপগান হবে, প্রমোদ হবে, বনভোজন হবে, মানুষ নৌকা ভ্রমণে যাবে, অর্থাৎ প্রমোদের একটা লীলাক্ষেত্রে পরিণত হবে। সংস্কৃতির যে একটা কেন্দ্র ছিল, দাঁড়ানোর যে একটা জায়গা ছিল, সেই জায়গাটাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। এটা একটা দৃষ্টান্ত। এভাবে পৃথিবীতে বিশ্বায়নের নাম করে নিজস্বতাকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিজস্বতা চাই। আবার আন্তর্জাতিকতাও চাই। এই আন্তর্জাতিকতা হলো পৃথিবীর সব মানুষের মানবিক যে অধিকার, বাঁচার যে সংগ্রাম, মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার যে চেষ্টা তারই অংশ। সেই সংগ্রাম আজও চলছে সারা পৃথিবীতে। বহু যুগ ধরে চলছে। সেই সংগ্রামের উত্তরাধিকারকে, সংগ্রামের সহযোদ্ধাদের, আমরা আমাদের সঙ্গে নিতে চাই। বিশ্বের মানুষ যারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে লড়ছে, তাদের সে লড়াই আজ আমাদেরও লড়াই।
পুঁজিবাদ মানুষের সমস্যার সমাধান দেবে না। পুঁজিবাদ সব মানুষকে পণ্যে পরিণত করেছে। প্রকৃতি পণ্য হয়ে গেছে। নারীর মর্যাদা, সম্ভ্রম পণ্যে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্বে তাই আজকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে এবং সেই বিক্ষোভ আন্তর্জাতিক চরিত্র গ্রহণ করেছে। এই ব্যবস্থা সমগ্র পৃথিবীকে দূষিত করেছে। আমাদের ঢাকা শহরের কথা ধরুন, এই শহর সম্পর্কে আমরা কত রোমান্টিক ধারণা লালন করি। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কী? আজ এই শহর পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি। এই দূষণ কোথা থেকে এলো? এলো পুঁজিবাদী ভোগবাদিতা থেকে। পুঁজিবাদের যে গ্যাস পোড়ানো, তেল পোড়ানো, পৃথিবী তপ্ত হওয়া এ তারই প্রতিক্রিয়া। আজকে বাংলাদেশ কত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তা আমরা সব সময় অনুধাবন করি না। যেভাবে সমুদ্রের পানি উঁচু হচ্ছে, সেটি যদি হওয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে বন্যা ও খরা আমাদের নিত্যসহচর হবে এবং বাংলাদেশের বিরাট অংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। ধনী দেশ বিলাস করছে, সুখ ভোগ করছে, তারা তেল-গ্যাস পোড়াচ্ছে আর দুর্ভোগ আমাদের। তাই সমগ্র পৃথিবীতে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হচ্ছে। মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছে। আমরা ওই আন্তর্জাতিক প্রতিরোধেরই অংশ। আমরা আমাদের ভূমিতে দাঁড়িয়ে, আমাদের নিজস্বতাকে রক্ষা করে, আমাদের বৈচিত্র্যকে অক্ষুণœ রেখে আন্তর্জাতিক যে সংগ্রাম, মানুষের মুক্তির যে সংগ্রাম, দীর্ঘ যে ঐতিহ্য, দীর্ঘ যে অর্জন, সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করব।
আমরা প্রকৃতির কথা বলব। প্রকৃতি ও সংস্কৃতি এক জিনিস নয়। প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয় আর মানুষের সংস্কৃতি মানুষকেই তৈরি করতে হয়। সেজন্যই সংস্কৃতিতে সৃষ্টির কথা আসে, অনুশীলনের কথা আসে। আর সেজন্যই সংস্কৃতিতে আন্দোলনের প্রয়োজন হয়। মানুষ একা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। সেজন্য মানুষকে সংঘবদ্ধ হতে হয়। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা যখন সংঘবদ্ধ হই, তখন ওই কথা অবশ্যই আমাদের চেতনার মধ্যে থাকে যে, আমরা একা কিছু সৃষ্টি করতে পারব না এবং নিজে নিজে চিন্তা করলে আমরা শুধু হতাশই হব, চারদিকে কোনো আলো দেখতে পাব না। কিন্তু আমরা যখন সংঘবদ্ধ হব, দেশে সংঘবদ্ধ হব, আন্তর্জাতিকভাবে সংঘবদ্ধ হব, তখন আমরা আশা দেখতে পাব, তখন আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। সংস্কৃতিতে আমরা বৈচিত্র্য চাই, যে বৈচিত্র্য হলো বাগানের বৈচিত্র্য, জঙ্গলের বৈচিত্র্য নয়। একটা বাগান তৈরি করতে হলে যেমন শ্রমের, পরিকল্পনার, সৌন্দর্যবোধের দরকার হয়, যেমন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির দরকার হয়, তেমনি সংস্কৃতিতেও উদ্যম, পরিকল্পনা, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিÑ সবকিছুরই দরকার হবে এবং সংস্কৃতিকে যারা উন্নত করতে চায় তাদের দায়িত্ব রয়েছে। কেবল ঐক্যবদ্ধ হওয়া নয়, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে আদর্শের ভিত্তিতে। আজকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অভাব হলো আদর্শবাদিতার। আমাদের বড় বড় নেতা সবাই বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ছাত্ররাজনীতি এ দেশে যে বড় অবদান রেখেছে, এ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে, সামাজিক পরিবর্তনে, সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে অতীতে ছাত্ররা যে ভূমিকা রেখেছে, সেই ভূমিকা আজ আর নেই। তার কারণ হলো ওই আদর্শবাদিতা নেই, যে আদর্শবাদিতা সংগ্রামমুখর হতে পারে।
আমরা দেখেছি, বামপন্থি আন্দোলনের ওপরই মানুষ শেষ পর্যন্ত ভরসা করে। বামপন্থি আন্দোলনই সংস্কৃতিকে বিকশিত করবে, রাজনীতিতে পরিবর্তন আনবে, সমাজে মঙ্গল আনবে, এটা মানুষ জানে, কিন্তু বামপন্থি আন্দোলন আমাদের দেশে শক্তিশালী হয়নি। এর সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে এবং এই সাংস্কৃতিক কারণের জায়গায় এসে আমাদের বলতে হবে যে, দর্শনের অর্থাৎ আদর্শবাদের বড় বেশি প্রয়োজন।
আমরা আমাদের দেশে দর্শনের চর্চা তেমন করিনি। দর্শন বলতে এখানে অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম বোঝানো হয়। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখুন, সেখানে দর্শনের বিভাগগুলো ধর্ম অধ্যয়নের বিভাগে পরিণত হচ্ছে। দর্শন বিভাগে ধর্ম তো আছেই, আবার ধর্ম অধ্যয়নের জন্য বিভিন্ন বিভাগ এখন খোলা হয়েছে। দেশে মার্কসবাদ বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পাঠের তেমন বন্দোবস্ত নেই। ফলে ধর্মকেই আমরা দর্শন মনে করেছি। দর্শনের মধ্যে যে জিজ্ঞাসা থাকে, যে সংশয় থাকে, যে বিশ্লেষণ থাকে, সেটা আমাদের মধ্যে আসেনি। আর যে দর্শন এ দেশে কার্যকর, সেটা হলো আত্মসমর্পণের দর্শন, তার মূল কথা হলো ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ, প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ। সেই আত্মসমর্পণের দর্শনেই আমরা দীক্ষিত। কিন্তু যে দর্শন মানুষকে মেরুদণ্ড দেবে, মানুষকে দাঁড়ানোর জায়গা দেবে, আস্থা দেবে, শক্তি দেবে, সেই দর্শনের চর্চা, সেই বৈজ্ঞানিকতার চর্চা, সেই সংশয়ের চর্চা আমাদের এখানে তেমন হয়নি। অনেক সময় সংস্কৃতি বলতে আমরা শুধু গান বুঝি, নাটক বুঝি, কিন্তু সংস্কৃতির মর্মার্থ কী? তার ভেতরের দর্শনটা কী? সেই দর্শন তথা আদর্শটাকে আমরা খেয়াল করি না। দৃষ্টির বাইরে রাখি দর্শনের হাতে তৈরি এবং লালিত-পালিত আচরণবিধিকেও।
আদর্শ খুব জরুরি। আদর্শ না হলে যেকোনো শিল্পকর্ম দ্বিমাত্রিক শিল্প হয়, চ্যাপ্টা শিল্পকর্ম হয়, তার কোনো গভীরতা থাকে না। কোন দৃষ্টিতে আমি পৃথিবীটাকে দেখি, পৃথিবীটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করি, এটি খুবই জরুরি প্রশ্ন। পৃথিবীটাকে তো অনেকেই ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু ব্যাখ্যা করতে হবে পরিবর্তনের স্বার্থে, ব্যাখ্যা করতে হবে মেনে নেওয়ার জন্য নয়, আত্মসমর্পণের জন্য নয়। সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে এই যে দার্শনিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শবাদিতা একে আমরা বেশি গুরুত্ব দিতে চাইব।
পুঁজিবাদ একটা আদর্শ বটে, ব্যক্তির মুক্তি, ব্যক্তির স্বার্থ, ব্যক্তির মুনাফা এসবই এর আদর্শ, কিন্তু একটি বিপরীত আদর্শও রয়েছে। তা হলো সমষ্টির মুক্তি। সে আদর্শ বলে আমরা মুক্তি সবার মুক্তির সঙ্গে যুক্ত। সবার মুক্তি না এলে আমার মুক্তি ঘটবে না। এই আদর্শ বলে যে ব্যক্তি কখনো মুক্ত হতে পারে না, যদি তার চারপাশের সব মানুষ মুক্ত না হয়। যেমন বিষাক্ত ঢাকা শহরে ব্যায়াম করে কীভাবে আমি আমার স্বাস্থ্যকে রক্ষা করব? আমি কতক্ষণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে থাকব? কতক্ষণ বাড়ির মধ্যে থাকব, ডেঙ্গুজ্বর তো আমার বাড়ির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। পরিবেশ যখন বিষাক্ত, পুকুরের পানি যখন পচে গেছে, তখন কোনো মাছই আলাদা করে বাঁচতে পারবে না। সেই পুকুরের পানি পরিবর্তন করতে হবে। নতুন করে পুকুর খনন করা চাই, যাতে আমরা বাঁচতে পারি। মানুষের মতো বাঁচতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে বা ব্যক্তিগত উদ্দেশে আমরা পরিবর্তন আনতে পারব না, এই বিষাক্ত পরিবেশ বদলাতে পারব না। এজন্য আমাদের সমষ্টিগত পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা মাছ নই, যে আত্মসমর্পণ করব; আমরা মানুষ, তাই ওই পুকুর আমরা বদলে ফেলব। এটাই হলো আমাদের কাজ।
কিন্তু এই কাজ আদর্শ-নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হবে না। সংস্কৃতিতে কোনো আদর্শ-নিরপেক্ষতা নেই। আর এই যে সমাজ-পরিবর্তনের আদর্শের কথা বললাম, এই বাম ধারার আন্দোলনে এ দেশে সমাজ বিপ্লব হয়নি। অনেক ধরনের বিপ্লবের কথা আমরা শুনি। রাষ্ট্রনৈতিক বিপ্লব হয়। বড় রাষ্ট্র ছিল ব্রিটিশ আমলে। সে রাষ্ট্র ভাঙল। আমরা বলি বিপ্লব হলো। ছোট একটা রাষ্ট্র হলো পাকিস্তান। আবার বিপ্লব হলো। আর একটি ছোট রাষ্ট্রের জন্ম হলো, বাংলাদেশ। কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরের যে আদর্শ, রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী আদর্শ, যা ব্রিটিশ আমলে ছিল, সেই আদর্শ পাকিস্তান আমলে ছিল, সে আদর্শ আজ বাংলাদেশেও আছে। মাঝখানে যা ঘটেছে তা হলো যারা ব্রিটিশ আমলে সুযোগ ভোগ করেছে, পাকিস্তান আমলে তারাই, সেই শ্রেণির মানুষই আবার নতুন সুযোগ পেয়েছে। এরপর বাংলাদেশ হওয়াতে তারা আরও বেশি সুযোগ পেল। যারা এককালে মুসলিম লীগ করেছে, পরে তারা আওয়ামী মুসলিম লীগ করেছে, তারাই এখন নাম ভাঙিয়ে কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি হয়েছে। দৃষ্টান্ত আমাদের একজন ধনী ব্যক্তির ইতিহাসটা। তার বাবা পাকিস্তান আমলে প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, পরে বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং উর্দু যে রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত এই কথা জিন্নাহরও আগে তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার ছেলে আমাদের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন, বাংলাদেশের তিনি মস্ত লোক, যেমন তার বাবা পাকিস্তানের অত্যন্ত বড়লোক ছিলেন। আরও আগে ব্রিটিশ আমলেও তিনি বাংলার প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলিতে চিফ হুইপ ছিলেন। ওই শ্রেণির মানুষরাই, ব্রিটিশ আমলে যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই এখানে বড় হয়েছে, পাকিস্তান আমলে বেড়ে উঠে আরও সমৃদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ আমলে।( বাকি অংশ পড়ুন আগামীকাল)